Pages

Thursday, December 6, 2018

স্বামীনারায়ণ মতেও বিষ্ণু ও শিব একই ঈশ্বরের দুটি ভিন্ন রূপ মাত্র


হরিহর

হরিহর হল হিন্দু দেবতা বিষ্ণু (হরি) ও শিবের (হর) একটি মিশ্র রূপ। এই রূপটি শঙ্করনারায়ণ ("শঙ্কর" মানে শিব, এবং "নারায়ণ" নামে বিষ্ণু) নামেও পরিচিত। বৈষ্ণব ও শৈব ধর্মাবলম্বীরা এই রূপটিকে সর্বোচ্চ ঈশ্বরের একটি রূপ হিসেবে পূজা করেন। একই পরমেশ্বরের দুটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সহাবস্থান বোঝাতেও হিন্দু দর্শনে "হরিহর" কথাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বিষ্ণু ও শিবের স্বরূপ (বৈদিক ও পৌরাণিক ধর্মশাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে) এবং তাদের ভিন্ন বা অভিন্ন অবস্থা হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন শাখায় একটি বিতর্কের বিষয়।

বৈশিষ্ট্য
হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি বিষ্ণু ও শিবকে ঘিরে একাধিক কিংবদন্তি ও প্রথার জন্ম দিয়েছে। কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মতে শুধু বিষ্ণুই (ও তাঁর অবতারসমূহ) সর্বোচ্চ ঈশ্বর। আবার কোনো কোনো সম্প্রদায় শিবকে (তাঁর বিভিন্ন রূপভেদ সহ) সর্বোচ্চ ঈশ্বর মনে করে। কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মতে শিব ও বিষ্ণু একই ঈশ্বরের দুটি ভিন্ন রূপ এবং উভয়েই পরমেশ্বর। আবার কোনো কোনো সম্প্রদায় পরমেশ্বরকে নিরাকার (অদ্বৈত) মনে করে। তাঁরা বিষ্ণু ও শিবকে নিরাকার ব্রহ্মের দুটি ভিন্ন রূপ মনে করেন।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও সেগুলির অনুবাদ উদ্ধৃত করে প্রত্যেক মতের স্বপক্ষেই প্রমাণ দেওয়া যায়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই একটি রূপকে অপর রূপের ঊর্ধ্বে রাখা হয়। তবে আজও শৈবরা শিবকে এবং বৈষ্ণবরা বিষ্ণুকে অন্যান্য দেবতাদের উপরে স্থান দেন।

অভিন্নতা
শিবানন্দের মতে: "শিব ও বিষ্ণু এক ও অভিন্ন। তাঁরা স্বরূপত এক ও অভিন্ন। সর্বব্যাপী পরমাত্মা বা পরম সত্যের বিভিন্ন রূপের এই দুটি ভিন্ন নাম। ‘শিবস্য হৃদয়ং বিষ্ণুর্বিষ্ণোশ্চ হৃদয়ং শিবঃ’—শিব বিষ্ণুর হৃদয় ও একই ভাবে বিষ্ণু শিবের হৃদয়।"
স্বামীনারায়ণ মতেও বিষ্ণু ও শিব একই ঈশ্বরের দুটি ভিন্ন রূপ মাত্র।উল্লেখ্য, স্বামীনারায়ণ মতবাদ বৈষ্ণবদের মধ্যে সংখ্যালঘু হলেও সমসাময়িক স্মার্ত মতানুসারী হিন্দুধর্মে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি মত।

শিল্পকলা
হরিহরের মূর্তিটির অর্ধেক অংশ শিবের মতো, অর্ধেক অংশ বিষ্ণুর মতো। শিব অর্ধের মাথায় জটা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঘছাল পরা। এই অর্ধের গায়ের রং সাদাটে, কোথাও কোথাও ছাইমাখা। বিষ্ণু অর্ধটি মুকুট ও অন্যান্য অলংকার পরিহিত। এটির গায়ের রং কালো। শিব অংশটি যোগীদের মতো। বিষ্ণু অংশটি রাজসিক। তাই এই মূর্তিটিকে যোগী ও গৃহস্থের উভয়ের পূজার উপযোগী মনে করা হয়। যদিও অন্যমতে শিবকে গৃহস্থেরও আদর্শ মনে করা হয়। এবং সেই কারণেই তাঁকে বিষ্ণুর সঙ্গে একীকৃত করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

Wednesday, December 5, 2018

বিপদতারিনী বা বিপদনাশিনী কে ?


বিপদতারিনী

 যিঁনি সমগ্র বিপদ থেকে রক্ষা করেন বা যিঁনি বিপদ সমূহ নাশ করেন তিনিই বিপদতারিনী । যিঁনি দুর্গা তিনিই বিপদতারিনী । তিঁনি পুরাণে কৌষিকীদেবী নামে খ্যাতা । আবার তিনিই জয়দুর্গা । দেবীর উৎপত্তি হয়েছিলো ভগবান শিবের অর্ধাঙ্গিনী দেবী পার্বতীর কোষিকা থেকে- তাই তিনি কৌষিকী । পুরাণ মতে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই অসুরের হাতে দেবতারা পরাজিত হয়ে হিমালয়ে গিয়ে মহামায়ার স্তব করতে লাগলেন । সেই সময় ভগবতী পার্বতী সেই স্থান দিয়ে যাচ্ছিল্লেন। দেবী তাদের স্তব শুনে বললেন – “ আপনারা এখানে কার স্তব করিতেছেন ? ”
সেই সময় ভগবতী পার্বতীর শরীর থেকে তার মতন দেখতে আর এক জন দেবী বের হয়ে আসলেন । সেই নব আবির্ভূতা দেবী জানালেন – “ ইহারা আমারাই স্তব করিতেছেন ।”
এই দেবী যুদ্ধে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরের বধ করেছিলেন । এই দেবী মোহাচ্ছন্ন শুম্ভাসুরকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করে বলেছিলেন-

“ ঐকেবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা ।
পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্তো মদবিভূতয়ঃ ।। ”

( এই জগতে এক আমিই আছি । আমি ছাড়া আমার সাহায্যকারিনী আর কে আছে ? ওরে দুষ্ট ভাল করে দেখ , ব্রহ্মাণী প্রভৃতি শক্তি আমারই অভিন্না বিভুতি বা শক্তি । এই দেখ তারা আমার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ।”)
আর একটি পৌরাণিক গাঁথানুসারে একদা ভগবান মহাদেব রহস্যচ্ছলে দেবী পার্বতীকে ‘কালী’ বলে উপহাস করেন। এতে দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে তপস্যার মাধ্যমে নিজের “কৃষ্ণবর্ণা” রূপ পরিত্যাগ করলেন । সেই কৃষ্ণবর্ণা স্বরূপ দেবীই হলেন , দেবীর পার্বতীর অঙ্গ থেকে সৃষ্টা জয়দুর্গা বা কৌষিকীদেবী, বিপদতারিনীদুর্গা । দেবীর ধ্যান মন্ত্রঃ-

ওঁ কালাভ্রাভাং কটাক্ষৈররিকুলভয়দাং মৌলীবন্ধেন্দুরেখাম্ ।
শঙ্খং চক্রং কৃপাণং ত্রিশিখমপি করৈরুদ্বহন্তীং ত্রিনেত্রাম্ ।
সিংহাস্কন্ধাধিরুঢ়াং ত্রিভুবন – মখিলং তেজসা পুরয়ন্তীম্ ।
ধ্যায়েদ্ দুর্গাং জয়াখ্যাং ত্রিদশপরিবৃতাং সেবিতাং সিদ্ধিকামৈঃ ।।

এর অর্থ- কালাভ্র আভাং ( এর অর্থ দুই প্রকার হয়, একটি স্বর্ণ বর্ণা অপরটি কালো মেঘের ন্যায় ) , কটাক্ষে শত্রুকূলত্রাসিণী , কপালে চন্দ্রকলা শোভিতা, চারি হস্তে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ ও ত্রিশূল ধারিণী, ত্রিনয়না, সিংহোপরি সংস্থিতা , সমগ্র ত্রিভুবন স্বীয় তেজে পূর্ণকারিণী , দেবগণ- পরিবৃতা , সিদ্ধসঙ্ঘ সেবিতা জয়াখ্যা দুর্গার ধ্যন করি ।
এই জয়দুর্গা বা কৌষিকীদেবী, বিপদতারিনীদুর্গা । পঞ্চদেবতার একজন । দেবীর অনেক রূপ দেখা যায়। উত্তর ভারতে অষ্টাদশ রূপের ধ্যান ও পূজা হয়, কোথাও দশভুজা রূপে পূজা হয়, কোথাও আবার চতুর্ভুজা স্বর্ণ বর্ণা আবার কোথাও কৃষ্ণ বর্ণা রূপে পূজিতা হয় । জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে মঙ্গল ও শণিবারে মায়ের পূজো হয় । যেখানে ১৩ প্রকার ফল, পুস্প, মিষ্টি, পান সুপারী অর্পণ করা হয়। আসুন মায়ের চরণে প্রনাম জানাই। মা যেনো সকলের সর্ব প্রকার বিপদনাশ করেন ।

Monday, December 3, 2018

দশ মুখ্য অবতারের সমষ্টিগত নামই বিষ্ণু দশাবতার


দশাবতার বিষ্ণু

দশাবতার বিষ্ণু দশ প্রধান অবতার। বৈষ্ণব দর্শনে, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে মর্ত্যে অবতীর্ণ পরম সত্ত্বাকে অবতার নামে অভিহিত করা হয়। বিষ্ণুর (বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষ্ণের) দশ মুখ্য অবতারের সমষ্টিগত নামই দশাবতার। এই দশাবতারের কথা জানা যায় গরুড় পুরাণ
 (১।৮৬।১০-১১) থেকে। এই দশ অবতার মানব সমাজে তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ভিত্তিতে সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হন।
দশাবতারের অধিকাংশই অভিহিত হন লীলা-অবতার নামে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, প্রথম চার অবতারের আবির্ভাবকাল সত্যযুগ। পরবর্তী তিন অবতার ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ হন। অষ্টম ও নবম অবতারের আবির্ভাবকাল যথাক্রমে দ্বাপরযুগ ও কলিযুগ। দশম অবতার কল্কির আবির্ভাব ৪২৭,০০০ বছর পর কলিযুগের অন্তিম পর্বে ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। বিষ্ণু পুরাণ–এও বলা হয়েছে, কল্কি অবতারের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই কলিযুগের সমাপ্তি ঘটবে। কল্কি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে এক নতুন সত্যযুগের সূচনা ঘটাবেন।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ:-
অনুমিত হয়, ভাগবতধর্মের অধীনে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতাররূপে গ্রহণ গুপ্তযুগে (৩৩০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) দুই ধর্মের সম্পর্কের নৈকট্যের ফলস্রুতি। এই কারণে মহাযান বৌদ্ধধর্মকে অনেক সময় বুদ্ধ-ভাগবতধর্ম বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, গবেষকরা মনে করেন যে এই যুগেই হিন্দুধর্মে অবতারতত্ত্ব পূর্ণ বিকাশ লাভ করে।
ঐতিহাসিক বিষ্ণুধর্মের বিবর্তনের ফলে বর্তমানকালের জটিল বৈষ্ণবধর্মের উদ্ভব। বিষ্ণু, নারায়ণ, বাসুদেব ও কৃষ্ণের আরাধনাকেন্দ্রিক এই ধর্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠালাভ করে ভগবদ্গীতার যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী-খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দী)।
দ্বাদশ অলবর নামে পরিচিত সন্তেরা তাঁদের আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের মাধ্যমে এই সম্প্রদায়কে সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। পূর্বকালের অলবরগণ বিষ্ণুর অবতারদের পৃথকভাবে তালিকাভুক্ত করেননি। এমনকি তাঁরা কৃষ্ণকেও অবতাররূপে পৃথক করেননি। তামিল ভাষায় তাঁদের বিষ্ণু ও কৃষ্ণ স্তুতিগান নালয়িরা (দিব্য প্রবন্ধ) নামে পরিচিত।
তালিকা

১. মৎস্য
মাছরূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
২. কূর্ম
কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৩. বরাহ
বন্য শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৪. নৃসিংহ
অর্ধনরসিংহরূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৫. বামন
খর্বকায় বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৬. পরশুরাম
পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৭. রাম
অযোধ্যার যুবরাজ ও রাজা রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৮. কৃষ্ণ
দ্বাপরযুগে জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম সহ অবতীর্ণ। ভাগবত পুরাণ অনুসারে দ্বাপরযুগে অনন্ত নাগের অবতার বলরাম রূপে কৃষ্ণের সঙ্গে অবতীর্ণ হন। অধিকাংশ বৈষ্ণব শাখাসম্প্রদায় বলরামকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করেন। যে সকল সূত্রে বুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই সেখানে বলরামকেই বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে দশাবতারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৯. বলরাম
কোনো কোনো মতে বিষ্ণুর নবম অবতার।
১০. কল্কি
এই ভবিষ্যৎ অবতার কলিযুগের শেষ পর্বে অবতীর্ণ হবেন বলে হিন্দুরা মনে করেন।
জয়দেবের দশাবতার স্তোত্র
জয়দেব রচিত প্রলয়পয়োধিজলে (গীতগোবিন্দম্ কাব্যের প্রথম সর্গের প্রথম গীত, দশাবতার স্তোত্র নামে সমধিক পরিচিত) স্তোত্রে দশটি পৃথক স্তবকে দশ অবতারের বিবরণদানের পর নিম্নোক্ত শ্লোকে দশাবতারের কীর্তির একটি সুসংবদ্ধ তালিকা প্রদান করা হয়েছে:
বেদানুদ্ধরতে জগন্তি বহতে ভূগোলমুদ্বিভ্রতে
দৈত্যং দারয়তে বলিং ছলয়তে ক্ষত্রক্ষয়ং কুর্বতে।
পৌলস্ত্যং জয়তে হলং কলয়তে কারুণ্যমাতন্বতে
ম্লেচ্ছান মূর্চ্ছয়তে দশাকৃতিকৃতে কৃষ্ণায় তুভ্যং নমঃ।।
বেদের উদ্ধারকারী, ত্রিলোকের ভারবহনকারী, ভূমণ্ডল উত্তোলনকারী, হিরণ্যকশিপু বিদারণকারী, বলিকে ছলনাকারী, ক্ষত্রক্ষয়কারী, দশানন-সংহারকারী, হলকর্ষণকারী, করুণাবিতরণকারী, ম্লেচ্ছধ্বংসকারী, দশরূপধারী হে কৃষ্ণ, তোমায় প্রণাম করি।।

অবতারের বৈজ্ঞানিক বিবর্তন:-
মৎস - পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থলে প্রথমে জলচর প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। কুর্ম - উভচর প্রাণী। জল ও স্থল, দুই জায়গাতেই প্রাণীর বসবাস শুরু হয়। বরাহ - কেবল স্থলে বসবাস করতে শেখে অনেক জীব। নৃসিংহ - মানব জাতির পূর্বতন পশুসুলভ অবস্থা, যখন মানুষ পূর্ণতা পায়নি। বামন - মানুষে ক্ষুদ্র বিকাশ। পরশুরাম - মানুষের আদিম পর্যায়। প্রকৃতির কোলে জীবের বাস। মানুষের জীবনযাপন জঙ্গলে। সেখান থেকেই বিবর্তনের শুরু। রাম - সমাজ বিকাশে প্রথম উন্নত পর্যায়। সমাজ, গোষ্ঠী, মানুষ-এই কৃষ্টিতে উৎকর্ষতা লাভ করে। কৃষ্ণ - নিয়ে এলেন রাজনীতি। মানুষের বিবর্তন, সমাজের ধারাবাহিক পরিবর্তন এবং টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষের কূটনীতিক আচরণের এই প্রথম বৈজ্ঞানিক আবির্ভাব। বুদ্ধ - জ্ঞান ছাড়া পৃথিবী বর্ণহীন, অন্ধকার। কুসংস্কার দূর করে জ্ঞানদীপ্তকরণের অবতার গৌতম বুদ্ধ। বিষ্ণুর নবম অবতার তিনি। কল্কি - আসন্ন। এখনও সমাজ শ্রীবিষ্ণুর এই অবতারের অপেক্ষায়। মানুষের মধ্যে থাকবে এমন শক্তি যা হবে ধ্বংস ও সৃষ্টির ধারক ও বাহক।

শিবের তরুণী স্ত্রী ও মোক্ষদাত্রী শক্তিই কামাখ্যা নামে পরিচিত


কামাখ্যা মন্দির

কামাখ্যা মন্দির হল ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত হিন্দু দেবী কামাখ্যার একটি মন্দির। এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এই মন্দিরগুলিতে দশমহাবিদ্যা অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা – এই দশ দেবীর মন্দিরও রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে। হিন্দুদের, বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ।

বর্ণনা:-
কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে: গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ (যেগুলির স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির)। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত।  অন্যগুলির স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। এগুলিতে খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্র দেখা যায়। মন্দিরের চূড়াগুলি মৌচাকের মতো দেখতে। নিম্ন আসামের বহু মন্দিরে এই ধরনের চূড়া দেখা যায়। গর্ভগৃহটি আসলে ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত দেখা যায়।
গর্ভগৃহটি ছোটো ওঅন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়াই সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়। ভিতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে যেটি যোনির আকৃতিবিশিষ্ট। এটিততে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্ত দেখা যায়। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ।
কামাখ্যা মন্দির চত্বরের অন্যান্য মন্দিরগুলিতেই একই রকম যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথর দেখা যায়, যা ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল দ্বারা পূর্ণ থাকে।

কামাখ্যা মন্দিরের অধিষ্ঠান, এটির থেকে অনূমিত হয় মূল মন্দিরটি নাগারা স্থাপত্যশৈলীর মন্দির ছিল।
মধ্য আসামে এই ধরনের শিখর বা চূড়া অনেক মন্দিরেই দেখা যায়। এর চারপাশে বঙ্গীয় চারচালা স্থাপ্তত্যে অঙ্গশিখর থাকে। অন্তরাল নামে এক ধরনের স্থাপত্য দেখা যায়, যা আটচালা স্থাপত্যের অনুরূপ।
বর্তমান মন্দির ভবনটি অহোম রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত। এর মধ্যে প্রাচীন কোচ স্থাপত্যটি সযত্নে রক্ষিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ১৫৬৫ সাল নাগাদ কোচ রাজা চিলরায় মধ্যযুগীয় মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী অনুসারে মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করে দেন। এখন যে মৌচাক-আকারের চূড়াটি দেখা যায়, তা নিম্ন আসামের মন্দির স্থাপত্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মন্দিরের বাইরে গণেশ ও অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি খোদিত আছে।[১৪] মন্দিরের তিনটি প্রধান কক্ষ। পশ্চিমের কক্ষটি বৃহৎ ও আয়তাকার। সাধারণ তীর্থযাত্রীরা এটি পূজার জন্য ব্যবহার করেন না। মাঝের কক্ষটি বর্গাকার। এখানে দেবীর একটি ছোটো মূর্তি আছে। এই মূর্তিটি পরবর্তীকালে এখানে স্থাপিত হয়। এই কক্ষের দেওয়ালে নরনারায়ণ, অন্যান্য দেবদেবী ও তৎসম্পর্কিত শিলালেখ খোদিত আছে। মাঝের কক্ষটিই মূল গর্ভগৃহে নিয়ে যায়। এটি গুহার আকৃতিবিশিষ্ট। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথর ও ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনটি আছে। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে অম্বুবাচী মেলার সময় কামাখ্যা দেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদযাপন করা হয়। এই সময় মূল গর্ভগৃহের প্রস্রবনের জল আয়রন অক্সাইডের প্রভাবে লাল হয়ে থাকে। ফলে এটিকে ঋতুস্রাবের মতো দেখতে হয়।

ইতিহাস
প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের বর্মণ রাজবংশের শাসনকালে (৩৫০-৬৫০ খ্রিস্টাব্দ) এবং সপ্তম শতাব্দীর চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং-এর রচনাতেও কামাখ্যা উপেক্ষিত হয়েছে। সেই সময় কামাখ্যাকে অব্রাহ্মণ কিরাত জাতীয় উপাস্য দেবী মনে করা হত।[ নবম শতাব্দীতে ম্লেচ্ছ রাজবংশের বানমলবর্মদেবের তেজপুর লিপিতে প্রথম কামাখ্যার শিলালিপি-উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে এখানে একটি বিশাল মন্দির ছিল। জনশ্রুতি অনুসারে, সুলেমান কিরানির (১৫৬৬-১৫৭২) সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কামতা রাজ্য ক্রামণ করার সময় (১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দ) এই মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কথিত আছে, কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ এই ধ্বংসাবশেষ খুজে পান। তিনিই এই মন্দিরে পূজার পুনর্প্রবর্তন করেন। তবে তাঁর পুত্র নরনারায়ণের রাজত্বকালে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়। পুনর্নির্মাণের সময় পুরনো মন্দিরের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে অহোম রাজ্যের রাজারা এই মন্দিরটি আরও বড়ো করে তোলেন। অন্যান্য মন্দিরগুলি পরে নির্মিত হয়।
কামাক্ষ্যা

অহোম রাজত্বে কামাখ্যা
জনশ্রুতি অনুসারে, কোচবিহার রাজপরিবারকে দেবী কামাখ্যাই পূজার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কোচবিহার রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ভিন্ন এই মন্দির পরিচালনা কষ্টকর হয়ে ওঠে। ১৬৫৮ সালে অহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহ নিম্ন আসাম জয় করলে এই মন্দির সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। অহোম রাজারা শাক্ত বা শৈব ধর্মাবলম্বী হতেন। তাঁরাই এই মন্দির সংস্কার ও পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব নিতেন।
রুদ্র সিংহ (রাজত্বকাল (১৬৯৬-১৭১৪) বৃদ্ধবয়সে গুরুর নিকট দীক্ষাগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু প্রজা ব্রাহ্মণের কাছে মাথা নত করতে পারবেন না বলে তিনি পশ্চিমবঙ্গে দূত পাঠালেন। নদিয়া জেলার শান্তিপুরের কাছে মালিপোতার বিশিষ্ট শাক্ত পণ্ডিত কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্যকে তিনি আসামে আসার অনুরোধ জানালেন। কৃষ্ণরাম জানালেন, কামাখ্যা মন্দিরের দায়িত্ব দিলে, তবেই তিনি আসাম যাবেন। রাজা নিজে দীক্ষা না নিলেও, তাঁর পুত্রদের ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের কৃষ্ণরামের কাছে দীক্ষা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
রুদ্র সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শিব সিংহ (রাজত্বকাল ১৭১৪-১৭৪৪) রাজা হন। তিনি কামাখ্যা মন্দির ও পার্শ্ববর্তী বিরাট একটি ভূখণ্ড কৃষ্ণরামকে দেবত্তোর সম্পত্তি হিসেবে দান করেন। তাঁকে ও তাঁর বংশধরদের পর্বতীয়া গোঁসাই বলা হত। কারণ তাঁরা নীলাচল পর্বতের উপর থাকতেন। কামাখ্যা মন্দিরের অনেক পুরোহিত ও আসামের অনেক আধুনিক শাক্ত এই পর্বতীয়া গোঁসাইদের শিষ্য।

পূজা
অনুমিত হয়, প্রাচীনকালে কামাখ্যা ছিল খাসি উপজাতির বলিদানের জায়গা। এখনও বলিদান এখানে পূজার অঙ্গ। এখানে অনেক ভক্তই দেবীর উদ্দেশ্যে ছাগলবলি দেন।
কালিকা পুরাণ অনুসারে, কামাখ্যায় পূজা করলে সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়। শিবের তরুণী স্ত্রী ও মোক্ষদাত্রী শক্তিই কামাখ্যা নামে পরিচিত।
১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নীলাচল পর্বতে মঙ্গোলরা আক্রমণ কলে প্রথম তান্ত্রিক কামাখ্যা মন্দিরটি ধ্বংস হয়েছিল। দ্বিতীয় তান্ত্রিক মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল মুসলমান আক্রমণের সময়। আসামের অন্যান্য দেবীদের মতো, দেবী কামাখ্যার পূজাতেও আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণ দেখা যায়।দেবীকে যেসব নামে পূজা করা হয় তার মধ্যে অনেক স্থানীয় আর্য ও অনার্য দেবদেবীর নাম আছে।যোগিনী তন্ত্র অনুসারে, এই যোগিনী পীঠের ধর্মের উৎস কিরাতদের ধর্ম। বাণীকান্ত কাকতির মতে, গারো উপজাতির মানুষেরা কামাখ্যায় শূকর বলি দিত। এই প্রথা নরনারায়ণ-কর্তৃক নিযুক্ত পুরোহিতদের মধ্যেও দেখা যেত।
কামাখ্যার পূজা বামাচার ও দক্ষিণাচার উভয় মতেই হয়। সাধারণত ফুল দিয়েই পূজা দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে পশুবলি হয়। স্ত্রীপশু বলি সাধারণত নিষিদ্ধ হলেও, বহু পশুবলির ক্ষেত্রে এই নিয়মে ছাড় দেওয়া হয়।

কিংবদন্তি
বারাণসীর বৈদিক ঋষি বাৎস্যায়ন খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে নেপালের রাজার দ্বারস্থ হয়ে উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলিকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত ও তাদের নরবলি প্রথার গ্রহণযোগ্য বিকল্প চালু করার জন্য অনুরোধ করেন। বাৎস্যায়নের মতে, পূর্ব হিমালয়ের গারো পাহাড়ে তারা দেবীর তান্ত্রিক পূজা প্রচলিত ছিল। সেখানে আদিবাসীরা দেবীর যোনিকে ‘কামাকি’ নামে পূজা করত। ব্রাহ্মণ্যযুগে কালিকাপুরাণে সব দেবীকেই মহাশক্তির অংশ বলা হয়েছে। সেই হিসেবে, কামাক্ষ্যাও মহাশক্তির অংশ হিসেবে পূজিত হন।
কালিকা পুরাণের মতে, কামাখ্যা মন্দিরে সতী শিবের সঙ্গে বিহার করেন। এখানে তাঁর মৃতদেহের যোনি অংশটি বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দেবীভাগবত পুরাণের ১০৮ পীঠের তালিকায় যদিও এই তীর্থের নাম নেই। তবে অপর একটি তালিকায় কামাখ্যা নাম পাওয়া যায়।যোগিনী তন্ত্রে অবশ্য কালিকা পুরাণের মতকে অগ্রাহ্য করে কামাখ্যা কালী বলা হয়েছে এবং যোনির প্রতীকতত্ত্বের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

উৎসব
তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র হওয়ায় বার্ষিক অম্বুবাচী মেলা অনুষ্ঠানে এখানে প্রচুর মানুষ আসেন। এছাড়া বার্ষিক মনসা পূজাও মহাসমারোহে আয়োজিত হয়, দুর্গাপূজা কামাক্ষ্যা মন্দিরের একটি অন্যতম প্রধান উৎসব।

কালীর মতোই তারা তারিণী ভীষণা দেবী


তারা তারিণী

তারা হিন্দু দেবী কালীর একটি বিশিষ্ট রূপ। ইনি দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় মহাবিদ্যা। কালীর মতোই তারা ভীষণা দেবী। তারার বিভিন্ন রূপান্তর উগ্রতারা, নীল সরস্বতী, কুরুকুল্লা তারা, খদির বাহিনী তারা, মহাশ্রী তারা, বশ্যতারা, সিতাতারা, ষড়ভূজ সিতাতারা, মহামায়া বিজয়বাহিনী তারা ইত্যাদি। বৌদ্ধধর্মেও তারাদেবীর পূজা প্রচলিত। তারার মূর্তিকল্পনা কালী অপেক্ষাও প্রাচীনতর। কোনো কোনো মতে তারা দুর্গা বা চণ্ডীর রূপান্তর। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার তারাপীঠে অবস্থিত দেবী তারার মন্দির বিখ্যাত।

মূর্তিতত্ত্ব
হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য তার হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বইয়ে বলেছেন, তন্ত্রসারে দেবী তারার যে রূপ বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
তারা প্রত্যালীঢ়পদা অর্থাৎ শববক্ষে দক্ষিণপদ স্থাপিতা। ভয়ংকরী, মুণ্ডমালাভূষিতা, খর্বা, লম্বোদরী, ভীষণা, কটিতে ব্যাঘ্রচর্মাবৃতা, নবযৌবনা, পঞ্চমুদ্রা শোভিতা, চতুর্ভূজা, লোলজিহ্বা, মহাভীমা, বরদা, খড়্গ কাতরি দক্ষিণহস্তে ধৃতা, বামহস্তদ্বয়ে কপাল ও নীলপদ্ম, পিঙ্গলবর্ণ একজটাধারিণী, ললাটে অক্ষোভ্য প্রভাতসূর্যের মতো গোলাকার তিন নয়নশোভা, প্রজ্জ্বলিত চিতামধ্যে অবস্থিতা, ভীষণদন্তা, করালবদনা, নিজের আবেশে হাস্যমুখী, বিশ্বব্যাপ্ত জলের মধ্যে শ্বেতপদ্মের উপর অবস্থিতা।
তন্ত্রসারে তারার আরও একটি ধ্যানমন্ত্র বর্ণিত হয়েছে: "শ্যামবর্ণা ত্রিনয়না দ্বিভূজা, বরমুদ্রা ও পদ্মধারিণী, চতুর্দিকে বহুবর্ণা ও বহুরূপা শক্তির দ্বারা বেষ্টিতা, হাস্যমুখী মুক্তাভূষিতা, রত্নপাদুকায় পাদদ্বয় স্থাপনকারিণী তারাকে ধ্যান করবে।বৃহদ্ধর্ম পুরাণে তারাকে কেবল শ্যামবর্ণা ও কালরূপিণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তন্ত্রসারে তারাকেই মহানীল সরস্বতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতচন্দ্র রায় তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে তারার যে রূপবর্ণনা করেছেন, তা নিম্নরূপ:

তারা রূপ ধরি সতী হইলা সম্মুখ।।
নীলবরণা লোলজিহ্বা করালবদনা। সর্পবান্ধা ঊর্দ্ধ এক জটাবিভূষণা।।
অর্দ্ধচন্দ্র পাঁচখানি শোভিত কপাল। ত্রিনয়ন লম্বোদর পরা বাঘছাল।।
নীল পদ্ম খড়্গ কাতি সমুণ্ড খর্পর। চারি হাতে শোভে আরোহণ শিবোপর।।
তারাপীঠের ব্রহ্মশিলায় খোদিত তারামূর্তিটি দ্বিভূজা, সর্পযজ্ঞোপবীতে ভূষিতা এবং তাঁর বাম কোলে পুত্ররূপী শিব শায়িত।

Sunday, December 2, 2018

দক্ষিণাকালীর কালীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মূর্তি তাঁকে এক মহান মাতৃকা হিসাবে ভারতে পূজা করা হয়


দক্ষিণাকালী
দক্ষিণা কালী হিন্দু দেবী কালীর সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপ এবং জন্ম, স্থিতি, শক্তির দেবী ও প্রসিদ্ধ মূর্তি। তাঁকে শিবের সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দক্ষিণা কালীর রুপ মহাকালী ( মৃত্যু এবং সময়ের দেবী ) এবং শ্মশানকালীর ( ​​শ্মশানে পূজ্য দেবী ) থেকে কিছু ভিন্ন। তাঁকে এক মহান মাতৃকা হিসাবে ভারতে পূজা করা হয়।

নাম-ব্যুৎপত্তি
দক্ষিণা কালীর ডান পা শিবের বক্ষস্থলে। সেই কারণে কালীর এই রূপের নাম দক্ষিণাকালী। তাত্ত্বিকের তাঁর নামের যে ব্যাখ্যা দেন তা নিম্নরূপ: দক্ষিণদিকের অধিপতি যম যে কালীর ভয়ে পলায়ন করেন, তাঁর নাম দক্ষিণাকালী।

রামপ্রসাদ সেনের গুরু কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বপ্নে আদেশ পান কালীর প্রসন্ন ভাবমূর্তি রচনা করার। স্বপ্নে দেবী তাঁকে জানান পরবর্তী ভোরে যে নারীকে তিনি সর্বপ্রথম দেখবেন তার রূপ অনুযায়ী কালীর এক প্রসন্ন প্রতিমূর্তি তৈরী করতে। পরবর্তী ভোরে যে নারীকে প্রথম সে দেখেন তিনি কৃষ্ণবর্ণা, তার ডান পা সামনে, উন্মুক্ত কালো কেশ এবং বাম হাত উত্তোলনের দ্বারা দেয়ালে গোবর স্থাপন করছেন। আকস্মিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে সামনে দেখে সেই মহিলা খুব লজ্জা পেলেন এবং তার জিহ্বা বার করে দাঁত দিয়ে চাপলেন। সেই নারীর রূপ অনুসরণ করে আগমবাগীশ মহাশয় কালীর মূর্তিতত্ত্ব অনুযায়ী দক্ষিণা কালীর মূর্তি রচনা করেছিলেন। এর আগে কালী যন্ত্রে কালীপূজা হতো।

মূর্তিতত্ত্ব
দক্ষিণা কালীর ডান পা শিবের বুকে। তিনি কালীর অন্যান্য রূপ থেকে ভিন্ন এবং তাঁকে ঘর এবং মন্দিরে পূজা করা হয়। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। তাঁর বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুগলে বর ও অভয় মুদ্রা। তাঁর গাত্রবর্ণ গভীর নীল, আকাশ এবং নীল সমুদ্রের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। তাঁর গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। তাঁর দন্ত উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণ; তাঁর স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। তাঁর, দীর্ঘ এবং কালো চুল সভ্যতা থেকে প্রকৃতির স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব করে। দক্ষিণা কালীর তৃতীয় চক্ষুর নিচে সূর্য, চন্দ্র এবং অগ্নির প্রতীক দেখা যায় এবং এটি প্রকৃতির চালিকা শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।
তাঁর জিহ্বা আসক্তির ও লোলুপতার প্রতীক এবং সাদা দাঁত সত্যতার প্রতীক। তাঁর জিহ্বা দাঁত দ্বারা দমিত। এটি সত্য দ্বারা লোভ নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। উপাসকমণ্ডলী অনুযায়ী তিনি দিব্য মাতৃকা শক্তি বা পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর এবং চূড়ান্ত সত্য। তাঁর গলায় মুণ্ডমালার হার প্রজ্ঞার মাল্য এবং হয় ৫১ বা ১০৮ মানুষের মাথা আছে। সংস্কৃত ভাষায় ৫১ বর্ণমালা ও ১০৮ একটি সুপ্রসন্ন সংখ্যা।

তাঁর উপরের বাম হাতে খড়্গ শক্তির প্রতীক এবং নিচের বাম হাতে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড অহংএর প্রতীক। তাঁর খড়্গে একটি চোখ দেখা যায়। এটি প্রজ্ঞার প্রতীক। কালীর শক্তি খড়্গ জ্ঞান দ্বারা মানুষের অহং ছিন্ন করেন। দক্ষিণা কালী দক্ষিণকরযুগলে বর ও অভয় দান করছেন। এই দুই হাতের মানে হল, একটি সত্য হৃদয় দিয়ে যে কেউ তাঁর পূজা করতে পারেন।
দক্ষিণা কালী তাঁর কোমরের উপর ছিন্ন হাতের একটি ঘের পরেন যার মানে তিনি মানুষের কর্ম থেকে স্বাধীন এবং উচ্চতর।

ভগিনী নিবেদিতা তাঁর মাতৃরূপা কালী বইতে নিবেদিতা দেবী দক্ষিণেশ্বরের কালীর কথা আলোচনা করেছেন। দক্ষিণেশ্বরের কালী দক্ষিণা কালী। তাঁর পূজা করলে ত্রিবর্ণা তো বটেই সর্বোপরি সর্বশ্রেষ্ঠ ফলও দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়।

কাত্যায়নী হলেন শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামের রক্ষয়িত্রী দেবী বিমলা


শক্তিপীঠ বিমলা


কালিকাপুরাণ মতে, চার মহাপীঠ তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র। এগুলির মধ্যে পশ্চিমদিকের পীঠটি হল ওড্ডীয়ন বা উড্ডীয়ন অঞ্চলের কাত্যায়নী। এই পীঠের ভৈরব জগন্নাথ। বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, এই ওড্ডীয়ন বা উড্ডীয়ন হল আজকের ওড়িশা। আর এই কাত্যায়নী হলেন শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামের রক্ষয়িত্রী দেবী বিমলা। পীঠশক্তি রূপে কাত্যায়নীর নাম পাওয়া যায় হেবজ্র তন্ত্র গ্রন্থেও। সেখানে তাঁকে বলা হয়েছে উড্র পীঠের ভৈরবী। আর সেখানেও ভৈরব হলেন জগন্নাথ।

দক্ষকন্যা সতীর উপাখ্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হিন্দুদের একাধিক পুরাণে ও লোককথায়। ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ প্রজাপতির ছিল আট মেয়ে। তাঁদের মধ্যে সবার বড়ো ছিলেন সতী। দক্ষ সতীকে শিবের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। শিব শ্বশুরকে যথোচিত সম্মান করতেন না। বরং শ্বশুরের সামনেই তাঁর অশেষ গুণাবলির নিদর্শন স্থাপন করতেন। এজন্য দক্ষও তাঁর এই জামাইটির প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে সতীও হয়ে উঠেছিলেন বাবার বিশেষ অনাদরের পাত্রী। দক্ষ তাঁর অন্য মেয়ে-জামাইদের বাড়িতে ডাকতেন। কিন্তু শিব-সতীকে কখনই ডাকতেন না। সতীর বিয়ের কিছুদিন পরে দক্ষ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যথারীতি সেই যজ্ঞে তিনি অন্যান্য মেয়ে-জামাইদের আমন্ত্রণ জানালেন; শুধু ডাকলেন না শিব-সতীকে। সতী লোকমুখে জানলেন বাবার যজ্ঞ আয়োজনের খবর। তিনিও যজ্ঞস্থলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। শিব বারণ করলেন। সতী শুনলেন না। অনাহত হয়ে সটান যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে দক্ষকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘বাবা, দেবাদিদেব মহাদেব কেন এই যজ্ঞে আমন্ত্রিত হননি?’ দক্ষ উত্তরে বললেন, ‘শিব সংহারের দেবতা। তাই তিনি অমঙ্গল বয়ে আনতে পারেন। তাছাড়া তাঁর বেষভূষাও ভদ্রজনোচিত নয়। তিনি শ্মশানচারী। ভূতপ্রেত তাঁর নিত্যসঙ্গী। সেই সব নগ্ন অনুচরবৃন্দের সম্মুখে তিনি নানান কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে থাকেন। তাঁকে নিমন্ত্রণ করলে সমবেত সুধী দেবমণ্ডলীর সামনে আমাকেও অপ্রস্তুত হতে হবে। সেই কারণেই শিবকে এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করা হয়নি।’ মঙ্গলময় জগদ্‌গুরু শিব। তায় তিনি তাঁর প্রাণের ঠাকুর। বাপের মুখে পতিনিন্দা সতীর প্রাণে শেলের মতো বিঁধল। যজ্ঞাগ্নিতে সতী-দেহ আহুতি দিলেন শিবানী। সতীর দেহত্যাগের সংবাদ পৌঁছালো দেবাদিদেবের কানে। ক্রোধে উন্মত্ত দেবাদিদেব বীরভদ্র, ভদ্রকালী প্রমুখ অনুচরবৃন্দকে দিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করালেন। কন্যার দেহত্যাগের কারণ দক্ষের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। তারপর সতীর অর্ধদগ্ধ দেহ কাঁধে তুলে উন্মত্তের মতো ছুটে বেড়াতে লাগলেন এলোক থেকে সেলোক। ত্রিভুবন ধ্বংস হওয়ার জোগাড় হল তাঁর ক্রোধের তেজে। তাই আসরে নামতে হল বিষ্ণুকে। সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ছড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। সতীদেহের অন্তর্ধানে শান্ত হলেন শিব। বসলেন মহাধ্যানে।
এদিকে সতীর দেহের খণ্ডগুলি ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে জন্ম দিল এক এক মহাপীঠের। শক্তিপীঠগুলির সংখ্যা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। পীঠনির্ণয় ও তন্ত্রচূড়ামণি মতে পীঠের সংখ্যা ৫১। শিবচরিত মতে ৫১ পীঠ ও ৫১ উপপীঠ। আবার সর্বশ্রেষ্ঠ শাক্ত পুরাণ দেবীভাগবত মতে ১০৮ পীঠ। বিমলা শক্তিপীঠের উল্লেখ বেশ কয়েকটি প্রধান গ্রন্থে পাওয়া যায়। আবার এই পীঠকে একাধিক নামেও চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যায়।
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থের ‘পীঠনির্ণয়’ বা ‘মহাপীঠনির্ণয়’ অংশে উৎকলের বিরজা ক্ষেত্রকে শক্তিপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই পীঠের শক্তি বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। সতীর নাভি এখানে পড়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই গ্রন্থে। তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থেই অন্য একটি অধ্যায়ে অবশ্য বিমলাকে উপপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এখানে সতীর উচ্ছিষ্ট পড়েছিল। তন্ত্রচূড়ামণি মন্দিরের অবস্থান উল্লেখ করতে গিয়ে ‘নীলাচল’ কথাটির উল্লেখ করেছে। নীলাচল বা নীলপর্বতের উল্লেখ শিবচরিত গ্রন্থেও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেও বিমলা উপপীঠ। এখানকার শক্তি বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। উল্লেখ্য, নীলাচল নামটি জগন্নাথ ক্ষেত্রের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত। সতীর উচ্ছিষ্ট পড়ার ঘটনার সঙ্গে জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট ভোগে বিমলার পূজার কোনো যোগ থাকাও অসম্ভব নয়। তবে সেসব গবেষকদের আলোচনার বিষয়।
ফিরে আসি অন্যান্য তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থগুলির আলোচনায়। কুব্জিকাতন্ত্র বলে, বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি। এখানে সাধনা করলে সিদ্ধাই নামে এক ধরনের অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা সম্ভব। দেবীভাগবত পুরাণ, প্রাণতোষিণী তন্ত্র ও বৃহৎ নীলতন্ত্র মতে, বিমলা ১০৮ শক্তিপীঠের অন্যতম। দেবীপুরাণ মতে, এখানে পড়েছিল সতীর পা। মৎস্যপুরাণ মতে, পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলা একটি শক্তিপীঠ। বামনপুরাণ মতেও এটি একটি মহাতীর্থ। মহাপীঠ নিরুপণ গ্রন্থে বিমলা ও জগন্নাথকে এই তীর্থের পীঠদেবতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাশক্তির ১০৮ পৌরাণিক নামের তালিকা নামাষ্টত্তরশত গ্রন্থেও পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলার উল্লেখ পাওয়া যায়।
শক্তিপীঠ বিমলা
এখানে একটি প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক। ‘ভৈরব’ শব্দটি ও শাক্ত-তান্ত্রিক শক্তিপীঠের ভৈরব ধারণাটির সঙ্গে সাধারণত যে দেবতার সম্পর্ক তিনি দেবাদিদেব মহাদেব। নারায়ণ বা কৃষ্ণ নন। রামানুজী বিশিষ্টাদ্বৈত বা চৈতন্য-অনুসারী গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে পুরীর জগন্নাথ নারায়ণ বা কৃষ্ণের স্বরূপ। বিভিন্ন শাস্ত্রেও দেবী বিমলাকে কাত্যায়নী, দুর্গা, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী বা একানংশা দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নারায়ণ-পত্নী লক্ষ্মী বা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধার সঙ্গে বিমলার কোনো সাদৃশ্য আদৌ দেখা যায় না। তবে কেন জগন্নাথকে ভৈরব বলা হল? কেনই বা তিনি দুর্গা-স্বরূপা বিমলার ভৈরব হলেন?
এর দুটি ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। একটি অদ্বৈত একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, শিব ও বিষ্ণু অভিন্ন। তাই শিবশক্তি দুর্গা ও বিষ্ণুশক্তি লক্ষ্মীও অভিন্না। সেই অর্থেই জগন্নাথ বিমলার ভৈরব। তবে এই ব্যাখ্যা ততটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, বিমলার সঙ্গে  শৈব-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের যোগ যতখানি, অদ্বৈত সম্প্রদায়ের যোগ ততখানি নয়। তন্ত্র মতে, জগন্নাথ নারায়ণ বা কৃষ্ণের নয়, শিবের রূপ। সেই জন্যই তিনি শিব-ভৈরব। মনে হয়, এই কারণেই তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে জগন্নাথকে ভৈরব আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর তাই শাক্ত বিশ্বাসে দেবী বিমলা হয়ে উঠেছেন পুরুষোত্তম শক্তিপীঠের প্রধান দেবী তথা জগন্নাথ মন্দিরের রক্ষয়িত্রী।

এ তো গেল শাস্ত্রের কথা। কিন্তু ইতিহাস কী বলে?
ইতিহাস বলে, বিমলা মন্দিরের ইতিহাস সম্ভবত বৈষ্ণব জগন্নাথ-কাল্টের চেয়েও প্রাচীন। জগন্নাথ মন্দিরের বর্তমান কাঠামোটি খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর পরে নির্মিত। অথচ বর্তমান বিমলা মন্দিরটি খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজত্বকালে নির্মিত। তাও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়েছে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত আদি বিমলা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপরই গড়ে উঠেছে নবম শতাব্দীর এই মন্দিরটি। জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রোহিণীকুণ্ডের পাশে অবস্থিত বিমলা মন্দিরের সঙ্গে মন্দির চত্বরের মুক্তিমণ্ডপের কাছে অবস্থিত নৃসিংহ মন্দিরের স্থাপত্যগত মিলটি বেশ লক্ষণীয়। মাদলা পাঁজি বলছে, দক্ষিণ কোশলের সোমবংশী রাজবংশের রাজা যযাতি কেশরী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।  উল্লেখ্য, এই বংশের রাজা প্রথম যযাতি (খ্রিস্টীয় ৯২২–৯৫৫) ও দ্বিতীয় যযাতি (খ্রিস্টীয় ১০২৫–১০৪০) উভয়েই “যযাতি কেশরী” নামে পরিচিত ছিলেন। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী–বিশেষত পার্শ্বদেবতাদের মূর্তি ও মূল মূর্তিটির পিছনের পাথরের খণ্ডটি সোমবংশী শৈলীর নিদর্শন বহন করে। হয়তো এগুলি আদি মন্দিরেরই অংশ ছিল। তাই বলাই যায়, চত্বরের প্রধান মন্দির জগন্নাথ মন্দিরের তুলনায় দেবী বিমলার মন্দির প্রাচীনতর।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য পুরীতে গোবর্ধন মঠ স্থাপন করেছিলেন বিমলাকে প্রধান দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। প্রথা অনুসারে, আজও গোবর্ধন মঠের অধ্যক্ষ পুরীর শঙ্করাচার্য বিমলা মন্দিরের প্রসাদ হিসেবে এক থালা মহাপ্রসাদ ও এক থালা খিচুড়ি ভোগ রোজ পেয়ে থাকেন। দ্য জগন্নাথ টেম্পল অ্যাট পুরী গ্রন্থের লেখক স্টারজার মতে, প্রাচীনকালে জগন্নাথ মন্দির ছিল ত্রিমূর্তি অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবপূজার কেন্দ্র। এই তিন দেবতার শক্তি তথা হিন্দুধর্মের প্রধান তিন দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতীও তাই পূজিত হতেন জগন্নাথ মন্দিরে। তার মধ্যে দেবী পার্বতীর পূজা হত বিমলা রূপে। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত পুরীতে শ্রীবিদ্যা উপাসনার প্রাবল্য লক্ষিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবধর্ম জগন্নাথ মন্দির চত্বরে প্রাধান্য বিস্তার করে। কমে যায় শ্রীবিদ্যা ও শৈব-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের প্রভাব। তবে এই প্রভাব একেবারেই অবলুপ্ত হয়নি। তান্ত্রিক পঞ্চমকার উপচারের বদলে বিমলা মন্দিরে নিরামিশ ভোগ ও দেবদাসী নৃত্যের প্রথা চালু হয়েছিল। তবে মাছভোগ দেবার প্রথাটি বজায় ছিল। রাজা নরসিংহদেব (শাসনকাল ১৬৩২–৪৭ খ্রিস্টাব্দ) মন্দিরে মাছ ও মাংস ভোগের প্রথা বন্ধ করে দেন। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই প্রথা আবার চালু হয়। বর্তমানে বিমলা মন্দিরের জন্য সাধারণত আলাদা ভোগ রান্না করা হয় না। জগন্নাথের নিরামিশ ভোগই দেবী বিমলাকে নিবেদন করা হয়। শুধু দুর্গাপূজার সময় দেবীকে আমিষ ভোগ দেবার প্রথা রয়েছে। এই সময় খুব ভোরে গোপনে মন্দিরে পাঁঠাবলিও হয়। স্থানীয় মার্কণ্ড মন্দিরের জলাশয় থেকে মাছ ধরে এনে রান্না করে বিমলাকে নিবেদন করা হয়। পূজা হয় তন্ত্র মতে। এই সব অনুষ্ঠান ভোরে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা খোলার আগেই সেরে ফেলা হয়। বৈষ্ণব ও স্ত্রী ভক্তদের এই সময় বিমলা মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। অনুষ্ঠানের অল্প কয়েকজন দর্শকই শুধু “বিমলা পারুষ” বা বিমলার আমিষ ভোগ পান। দেবী বিমলার ভক্তদের বিশ্বাস, দুর্গাপূজায় দেবী উগ্রমূর্তি ধারণ করেন। সেই সময় তাঁকে শান্ত করতে আমিষ ভোগ দিতেই হয়। যদিও এই মন্দিরে পশুবলি ও আমিষ ভোগ নিবেদন নিয়ে বৈষ্ণবদের আপত্তিও সুবিদিত।
বেলেপাথর ও ল্যাটেরাইটে নির্মিত বিমলা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীটি কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীর দেউল রীতির নিদর্শন। মন্দিরের চারটি অংশ: বিমান (গর্ভগৃহ যে অংশে অবস্থিত), জগমোহন (সভাঘর), নাটমণ্ডপ (উৎসবাদির স্থান) ও ভোগমণ্ডপ (ভোগ ও বিনোদনের স্থান)। এর মধ্যে বিমান অংশটি রেখ দেউল। এর আকার শম্বুকাকৃতির চিনির ডেলার মতো। বিমলা মন্দিরের বিমানটির উচ্চতা ৬০ ফুট। গায়ে নানারকম ছবি খোদাই করা। কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে রাখা আছে দেবী বিমলার মূর্তিটি। দেবী এখানে চতুর্ভূজা। তাঁর তিন হাতে জপমালা, বরমুদ্রা ও অমৃতকুম্ভ। চতুর্থ হাতের বস্তুটি ঠিক কী, তা নিয়ে মতান্তর দেখা যায়। তবে দেবী দুর্গার যে মূর্তি আমরা সচরাচর দেখতে অভ্যস্থ, দেবী বিমলার মূর্তি আদৌ সে রকম নয়। শুধু দেবী পার্বতীর দুই সখি জয়া ও বিজয়াকে দেবী বিমলার দুই পাশে দেখা যায়। মূর্তির উচ্চতা ৪ ফুটের কিছু বেশি।
বিমানের বাইরে জগমোহন, নাটমণ্ডপ ও ভোগমণ্ডপও নানারকম খোদাইচিত্রে শোভিত। বিমানে তিনটি কুলুঙ্গি আছে। তার একটিতে অষ্টভূজা মহিষমর্দিনী ও আর একটিতে ষড়ভূজা চামুণ্ডার মূর্তি দেখা যায়। তৃতীয় কুলুঙ্গিটি খালি। সম্ভবত সেখানকার দেবীমূর্তিটি চুরি গিয়েছে। জগমোহনের বৈশিষ্ট্য এর পিরামিড-আকৃতির ছাদ। নাটমণ্ডপে দশমহাবিদ্যা সহ মোট ষোলোজন হিন্দু দেবীর মূর্তি অঙ্কিত আছে। ভোগমণ্ডপের কুলুঙ্গিতে আছে অষ্টভূজ গণেষ ও ষড়ানন কার্তিকের মূর্তি। এছাড়া ভোগমণ্ডপের প্রবেশপথের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দেবী বিমলার বাহন গজসিংহ – পরাজিত হাতির উপর দাঁড়ানো বিজয়দর্পে গর্বিত এক সিংহ।
২০০৫ সালে বিমলা মন্দির সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমানে এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ভুবনেশ্বর সার্কেল।
বিমলা মন্দিরের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে ষোলোদিন ধরে মন্দিরে উদযাপিত হয় দুর্গাপূজা। পুরীর রাজা বিজয়াদশমীর দিন বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার রূপে পূজা করেন। এই মন্দিরের দুর্গাপূজার সবচেয়ে পুরনো উল্লেখটি পাওয়া যায়এখন নতুন দিল্লিতে রাখা কোণার্ক শিলালিপিতে (খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী)। এই শিলালিপির তথ্য অনুসারে, রাজা প্রথম নরসিংহদেব (রাজত্বকাল: ১২৩৮–১২৬৪) বিজয়াদশমীর দিন দুর্গা-মাধব (বিমলা-জগন্নাথ) পূজা করেছিলেন। হিন্দুধর্মের সনাতন বিশ্বাস, মেয়েরা কোমলস্বভাব। তাই বিমলার উগ্রমূর্তি মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা আজও দেখতে দেওয়া হয় না মেয়েদের।
বিমলা মন্দিরের একটি বৈশিষ্ট্য হল, জগন্নাথের প্রসাদী নারকেল বাটা, পনির ও মাখন দিয়ে শুকনো ভাত দিয়ে দেবী বিমলার নিত্যভোগের ব্যবস্থা। দুর্গাপূজার আমিষ ভোগ রান্নার ব্যবস্থা ছাড়া বিমলা মন্দিরের জন্য পৃথক ভোগ রান্নার ব্যবস্থা নেই। উচ্ছিষ্ট ভোগে হিন্দুধর্মে দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ। তবে বিমলা মন্দিরে কেন এই ব্যবস্থা? ওড়িশায় একটি লোকশ্রুতি আছে এই নিয়ে। বৈকুণ্ঠে নারায়ণ-দর্শনে গিয়েছেন দেবাদিদেব মহাদেব। নারায়ণ তখন খেতে বসেছেন। মহাদেব দেখলেন, নারায়ণের থালা থেকে তাঁর ভোজ্যের কয়েক টুকরো উচ্ছিষ্ট পড়েছে মাটিতে। প্রসাদজ্ঞানে সেই উচ্ছিষ্ট তুলে মুখে দিলেন মহাদেব। সেসময় তাঁর অনবধানে কিছুটা লেগে রইল তাঁর দাড়িতে। কৈলাশে ফেরার পর মহাদেব দেখলেন, তাঁর পথ চেয়ে অপেক্ষা করে আছেন দেবর্ষি নারদ। নারদ দেখলেন মহাদেবের দাড়িতে লেগে আছে ভোজনাবশেষ। তিনি জানতেন, মহাদেব গিয়েছিলেন বৈকুণ্ঠে নারায়ণ-সন্দর্শনে। দুইয়ে দুইয়ে চার করলেন নারদ। তাঁর বুঝতে দেরি হল না, মহাদেব যাঁর শ্রেষ্ঠ ভক্ত, সেই নারায়ণেরই উচ্ছিষ্ট লেগে রয়েছে মহাদেবের দাড়িতে। তিনি চকিতে সেই উচ্ছিষ্ট তুলে নিয়ে মুখে দিলেন। ঘটনাটি নজর এড়ালো না শিবপত্নী পার্বতীর। ক্ষুণ্ণ হলেন তিনি। সোজা চলে এলেন বৈকুণ্ঠে। নালিশ জানালেন, নারায়ণ-প্রসাদে তাঁর ন্যায্য পাওনা থেকে দেবর্ষি তাঁকে বঞ্চিত করেছেন। তখন পার্বতীকে শান্ত করে নারায়ণ বললেন, “দেবী, দুঃখ কোরো না। কলিযুগে বিমলা রূপে নিত্য আমার প্রসাদ পাবে তুমি।” ভক্তেরা বলেন, সেই থেকে পুরীর মন্দিরে জগন্নাথের প্রসাদী অন্নে বিমলার পূজার নিয়ম।  উল্লেখ্য, জগন্নাথের প্রসাদ বিমলাকে উৎসর্গ করার পরই তা পায় মহাপ্রসাদের মর্যাদা।
শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে বিমলা মন্দির একটি মহাতীর্থ। ওড়িশাবাসী শাক্তদের কাছে বিমলা প্রধান শাক্ততীর্থ। তান্ত্রিকদের কাছে তো এই মন্দিরের গুরুত্ব মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও বেশি।  জগন্নাথ মন্দিরের প্রথা অনুসারে, মূল মন্দিরে জগন্নাথকে পূজা করার বিমলাকে পূজা করা হয়।  প্রতিদিন এই মন্দিরের গর্ভমন্দির মুখরিত হয় শ্রীশ্রীচণ্ডী, আদি শঙ্করাচার্যের ‘দেব্যাপরাধক্ষমাপণ স্ত্রোত্র’ ও পুরুষোত্তম রক্ষিতের ‘বিমলাষ্টক স্তোত্রে’র সুরে। সন্তান আকুতি জানান, “মা, তোমার চরণসেবা করিনি কোনোদিন। কোনোদিন কিছুই ভালবেসে তুলে দিই নি তোমার হাতে। তবু আমাকে তোমার স্নেহের ছায়া থেকে কোনোদিন বঞ্চিত করোনি তুমি। আমি জানি, কুপুত্র জন্মায়, কিন্তু কুমাতা কখনও হয় না। আমার মতো পাপী আর কেউ নেই। তোমার মতো পাপঘ্নীও কেউ নেই। তাই হে জগজ্জননী, এরূপ জেনে যা উচিত তাই করো!”

বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে যথাক্রমে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের অধীশ্বর বলে মনে করা হয়


ব্রহ্মা

ব্রহ্মা  হিন্দুধর্মে সৃষ্টির দেবতা। বিষ্ণু ও শিবের সঙ্গে তিনি ত্রিমূর্তিতে বিরাজমান। তিনি অবশ্য হিন্দু বেদান্ত দর্শনের সর্বোচ্চ দিব্যসত্ত্বা ব্রহ্মের সমরূপ নন। বরং বৈদিক দেবতা প্রজাপতিকে ব্রহ্মার সমরূপ বলা চলে। বিদ্যাদেবী সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী।

নাম
সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে, মূল বিশেষ্য প্রাতিপদিক ব্রহ্মন্ শব্দটি থেকে দুটি পৃথক বিশেষ্য সৃষ্টি হয়েছে। একটি ক্লীব বিশেষ্য ব্রহ্মন্ ; এই শব্দের কর্তৃপদমূলক একবচন রূপটি হল ব্রহ্ম (সংস্কৃত: ब्रह्म)। এই বিশেষ্যটির একটি সাধারণ ও বিমূর্ত অর্থ রয়েছে।
এর বিপরীতে রয়েছে পুং বিশেষ্য ব্রহ্মন্ । এই শব্দের কর্তৃপদমূলক একবচন রূপটিই হল ব্রহ্মা (সংস্কৃত: ब्रह्मा)। এই শব্দটি ব্যক্তিনাম ও হিন্দু সৃষ্টিদেবতার নাম হিসেবে ব্যবহৃত। এঁকে নিয়েই আমাদের বর্তমান নিবন্ধ।
ব্রহ্মা মালয় ভাষায় বেরাহমা ও থাই ভাষায় ফ্রা ফ্রোম নামে পরিচিত। বাংলা ভাষায় লোকমুখে তাঁকে বহরম বা বিরিঞ্চি-ও বলা হয়ে থাকে
ধ্যানমন্ত্র
ব্রহ্মা কমণ্ডলুধরশ্চতুর্বক্রশ্চতুর্ভুজঃ।
কদাচিৎরক্তকমলে হংসারূঢ়ঃ কদাচন।।
বর্ণেন রক্তগৌরাঙ্গঃ প্রাংশুস্তুঙ্গাঙ্গ উন্নতঃ
কমণ্ডলুর্বামকরে স্রুবো হস্তে তু দক্ষিণে।
দক্ষিণাধস্তথা মালা বামাধশ্চ তথা স্রুবঃ।
আজ্যস্থালী বামপার্শ্বে বেদাঃ সর্বেহগ্রত স্থিতাঃ।।
সাবিত্রী বামপার্শ্বস্থা দক্ষিণস্থা সরস্বতী।
সর্বে চ ঋষয়োহ্যগ্রে কুর্যাদেভিশ্চ চিন্তনম।।

অর্থঃ ব্রহ্মা কমণ্ডলুধারী, তাঁর চারটি মুখ। তিনি কখনও লাল পদ্মে, কখনও শ্বেতহংসের উপর আসীন। তাঁর গায়ের রং লাল গৌরবর্ণ। তিনি লম্বা এবং উন্নত অঙ্গধারী। তাঁর উপরের বামহাতে কমণ্ডলু, ডানহাতে স্রুব। নিচের বামহাতে স্রুব এবং ডানহাতে জপমালা। তাঁর বামপাশে আজ্যস্থালী এবং সম্মুখে বেদসকল এবং ঋষিগণ। ব্রহ্মার বামপাশে সাবিত্রী এবং ডানপাশে সরস্বতী দেবী বিরাজিতা। ঋষিগণ এভাবেই ব্রহ্মার ধ্যান করেন।

পৌরাণিক উপাখ্যান
সৃষ্টির প্রারম্ভে ব্রহ্মা প্রজাপতিদের সৃষ্টি করেন। এই প্রজাপতিরাই মানবজাতির আদিপিতা। মনুস্মৃতি গ্রন্থে এই প্রজাপতিদের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন মারীচি, অত্রি, অঙ্গিরস, পুলস্ত, পুলহ, ক্রতুজ, বশিষ্ঠ, প্রচেতস বা দক্ষ, ভৃগু ও নারদ। সপ্তর্ষি নামে পরিচিত সাত মহান ঋষির স্রষ্টা ব্রহ্মা। এঁরা তাঁকে বিশ্বসৃষ্টির কাজে সহায়তা করেন। তাঁর এই পুত্রগণ তাঁর শরীর থেকে জাত হননি, হয়েছেন তাঁর মন থেকে। এই কারণে তাঁদের মানসপুত্র বলা হয়।
বেদ ও পুরাণ শাস্ত্র অনুসারে, ব্রহ্মা দেবতাদের বিষয়ে হস্তক্ষেপ বেশি করেন। নশ্বরদের ক্ষেত্রে তাঁর হস্তক্ষেপের ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম। তিনি সোমের উপর চাপ সৃষ্টি করে তারকাকে তাঁর স্বামী বৃহস্পতির নিকট ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করেন। তাঁকে ধর্ম ও অত্রির পিতারূপেও কল্পনা করা হয়

 
Design by দেবীমা | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | Facebook Themes